রাষ্ট্র

ভারতপিডিয়া থেকে
ImportMaster (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:০৯, ৩ মার্চ ২০২০ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (robot: Import articles using বিশেষ:আমদানি)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন
লেব্যাথনের ফ্রন্টপিসটি আব্রাহাম বোসে খোদাই করেছিলেন, লেখক টমাস হবস

রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাজনৈতিক সংগঠনকে বোঝায় যা কোন একটি ভৌগোলিক এলাকা ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সার্বভৌম ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্র সাধারণত একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক সীমার ভেতর বসবাসকারী সমাজের সদস্যদের শাসনের জন্য নিয়ম-কানুন তৈরি করে। যদিও একথা ঠিক যে রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পাওয়া না পাওয়া বহুলাংশে নির্ভর করে, রাষ্ট্র হিসেবে তার উপর প্রভাব রাখা ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির উপর।

ম্যাক্স ওয়েবারের প্রভাববিস্তারী সঙ্গানুযায়ী রাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক সংগঠন যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আইনানুগ বলপ্রয়োগের সব মাধ্যমের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখে, যাদের মধ্যে রয়েছে সশস্ত্রবাহিনী, নাগরিক, সমাজ, আমলাতন্ত্র, আদালত এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়ে মতভিন্নতার কারণে তাত্ত্বিক মহলে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এই আলোচনাকে কেন্দ্র করে যে ঠিক কিভাবে একটি “সার্থক রাষ্ট্র” এর অভ্যুদয়কে সমর্থন করা যেতে পারে।

সংজ্ঞা

ব্যাপকার্থে সরকার বা প্রাচীন-আধুনিক সব অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানকেই রাষ্ট্র প্রত্যয়টির অংশ হিসেবে ধরা হয়। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উল্ল্যেখযোগ্য সংখ্যক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যাদের সমন্বিত পদ্ধতির অংশ হয়ে ওঠাটা প্রথম স্পষ্টভাবে দেখা যায় ১৫ শতক নাগাদ। আর ঠিক সেসময়ই রাষ্ট্র প্রত্যয়টি তার আধুনিক অর্থ পরিগ্রহ করে। তাই রাষ্ট্র প্রত্যয়টি প্রায়ই নির্দিষ্ট করে শুধু আধুনিক রাজনৈতিক কাঠামোকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর স্বতন্ত্র পরিচয় থাকলেও তারা সম্পূর্ণভাবে সার্বভৌম নয়। এদের কর্তৃত্বের সীমা সেই সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে যা একই সাথে আংশিক বা অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর সমান সার্বভৌমত্ব থাকা সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রটির রূপরেখা নির্ধারণ করে। রাষ্ট্র কাঠামোর রূপ বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে সংগঠিত হতে পারে, যেমন – স্থানীয়/পৌর, প্রাদেশিক/আঞ্চলিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় এমনকি সাম্রাজ্য বা জাতি-সংস্থার মত আন্তর্জাতিক রূপেও তা থাকতে পারে।

চলতি ধারণা অনুযায়ী দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র প্রত্যয়গুলি প্রায়ই এমনভাবে ব্যবহৃত হয় যেন তারা সমার্থক; কিন্তু আরো সুচারু ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে

  • দেশ বলতে ভৌগোলিক এলাকা বোঝানো হয়।
  • জাতি বলতে সেই জনগণকে বোঝানো হয়, যাদের রীতিনীতি, পূর্বপুরুষ, ইতিহাস ইত্যাদি একই। যদিও বিশেষণ হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শব্দদুটি দিয়ে সেইসব বিষয়কে বোঝানো হয় যেগুলি স্পষ্টতই রাষ্ট্র-সংশ্লিষ্ট; যেমন জাতীয় রাজধানী, আন্তর্জাতিক আইন।
  • রাষ্ট্র সেইসব শাসনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহকে বোঝায় যাদের একটি নির্দিষ্ট এলাকা ও জনগণের উপর সার্বভৌম কর্তৃত্ব আছে।

আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি

কন্সটিটুটিভ থিওরি অফ স্টেটহুড (রাষ্ট্রের অঙ্গোপাদানগত তত্ত্ব)

কন্সটিটুটিভ থিওরি অফ স্টেটহুড - উনিশ শতকে বিকাশ লাভ করা এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে কোনটি রাষ্ট্র আর কোনটি রাষ্ট্র নয়। এই তত্ত্বানুযায়ী – কোন রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা নির্ভর করে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতির উপর। একারণে সদ্যোজাত রাষ্ট্র তৎক্ষণাৎ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশ হয়ে উঠতে পারেনা বা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে বাধ্য হতে পারেনা। একই সাথে স্বীকৃত রাষ্ট্রগুলোও ওই রাষ্ট্রের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে বাধ্য থাকবেনা।

এই তত্ত্বের উল্লেখ্যযোগ্য একটি সমালোচনা হচ্ছে এই যে এটি সেসব ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি তৈরি করে যেসব ক্ষেত্রে স্বীকৃত রাষ্ট্রসমূহের একাংশ নতুন রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দেয় কিন্তু আরেক অংশ দেয় না। অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করে নেয়াটা সংশ্লিষ্ট নতুন রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব, সমালোচনার জবাবে এই মত দেন তত্ত্বের প্রস্তাবকদের কেউ কেউ। যাহোক, একটি রাষ্ট্র অন্য একটি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে যেকোন মানদণ্ড বেছে নিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কেবলমাত্র স্বার্থসংশ্লিষ্টতা থাকলেই একটি রাষ্ট্র নতুন রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দিতে পারে।

মোন্তেবিদেও সম্মেলন

স্বীকৃতি পাওয়া প্রসঙ্গে ক্ষুদ্রজাতিসমূহ কর্তৃক উপস্থাপিত দলিলগুলোর অন্যতম একটি হলো মোন্তেবিদেও সমঝোতা। মোন্তেবিদেও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয় ১৯৩৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র, হন্ডুরাস, এল সালভাদর, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, হাইতি, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, মেক্সিকো, পানামা, বলিভিয়া, গুয়েতেমালা, ব্রাজিল, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া, কলম্বিয়া, চিলি, পেরু এবং কিউবার সম্মতিতে। যদিও এই সমঝোতা কোন আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। মোন্তেবিদেও সমঝোতায় চারটি শর্ত আছে যা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ইচ্ছুক “রাষ্ট্র”কে পূরণ করতে হবে –

  • স্থায়ী জনগণ
  • নির্ধারণকৃত এলাকা
  • সরকার
  • অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক তৈরির সক্ষমতা

এই শর্তগুলো পূরণ সহজসাধ্য বলে, মন্তেবিদেও সমঝোতা কখনোই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, বরং বেশিরভাগ দেশ আদর্শ হিসেবে কন্সটিটুটিভ থিওরি অফ স্টেটহুডকেই ব্যবহার করে।

ব্যুৎপত্তিগত অর্থ

বাংলা ভাষায় রাষ্ট্র শব্দটি ইংরেজি স্টেট শব্দের পারিভাষিক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি স্টেট শব্দটি মূলত ল্যাটিন স্ট্যাটাস শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ অবস্থা। যা কখনো আইনানুগভাবে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে এমন ব্যক্তিদের অস্তিত্ব থাকা, কখনো বা রাজার অবস্থা আবার কখনো বা প্রজাতন্ত্রের অবস্থা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রায়োগিক ও আইনি দৃষ্টিতে রাষ্ট্র শব্দের অর্থ

রাষ্ট্র শব্দের প্রায়োগিক ও আইনি উভয় রকমের অর্থ আছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র হিসেবে কোন কিছুর অস্তিত্বকে প্রায়োগিক দৃষ্টিতে বা আইনি দৃষ্টিতে অথবা উভয় দিক থেকেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

প্রায়োগিক দিক থেকে দেখতে গেলে, ম্যাক্স ওয়েবারের প্রভাবশালী সঙ্গানুযায়ী- এটি এমন একটি সংস্থা , নির্দিষ্ট এলাকার ভেতর আইনসিদ্ধ বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে যার রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। এমন কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট এলাকায় নিজস্ব আইনি আদেশ আরোপ করতে পারে, এমনকি যদি সেই কর্তৃপক্ষ আইনগতভাবে অপরাপর রাষ্ট্র দ্বারা, রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত নাও হয় তবুও। উদাহরণ হিসেবে সোমালিল্যান্ডের সোমালি অঞ্চলের কথা বলা যেতে পারে।

আইনি দিক থেকে দেখতে গেলে, কোন কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক আইনে রাষ্ট্র হতে পারে যদি অপরাপর রাষ্ট্রসমূহ তাকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, এমনকি তেমন ক্ষেত্রেও যেখানে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপর আইনসিদ্ধ বলপ্রয়োগের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব আসলে তার নেই। শুধুমাত্র আইনগতভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতায় অংশ নিতে পারে।

রাষ্ট্র, সরকার পদ্ধতি ও রাজনৈতিক কাঠামো

রাষ্ট্রের ধারণাকে প্রাসঙ্গিক অপর দুটি বিষয় থেকে স্পষ্টভাবে পৃথক করা যেতে পারে, যে দুটিকে প্রায়ই রাষ্ট্রের সমার্থক মনে করায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এই বিষয় দুটি হচ্ছে সরকারপদ্ধতি (গণতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র) এবং রাজনৈতিক কাঠামো। সরকার পদ্ধতি রাষ্ট্রের একটি মাত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে – সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ের বিভিন্ন কর্তা নির্ধারিত হয় এবং একই সাথে তাদের পারস্পারিক সম্পর্কের স্বরূপ ও জনগণের সাথে তাদের সম্পর্কের স্বরূপ নির্ধারিত হয়। এটি রাষ্ট্রের অন্যান্য দিকগুলো তুলে ধরে না যেগুলো রাষ্ট্রের প্রতিদিনকার কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। উদাহরণ হিসেবে আমলাতন্ত্রের মানের কথা বলা যেতে পারে। দুটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরস্পরের চেয়ে যথেষ্ট ভিন্ন হতে পারে যদি তাদের একটির প্রশিক্ষিত ও কার্যকর আমলাতন্ত্র বা বেসামরিক প্রশাসন থাকে কিন্তু অপরটির তা না থাকে। সাধারণভাবে বলতে গেলে রাষ্ট্র প্রত্যয়টি রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ারগুলোকে বোঝায়। অপর দিকে সরকারপদ্ধতি বলতে সেই প্রক্রিয়াকে বোঝায় যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারগুলো ব্যবহৃত হয় এবং নিয়োজিত হয়।

কোন কোন তাত্ত্বিকের মতে রাষ্ট্র প্রত্যয়টি অযথার্থ এবং রাষ্ট্র প্রত্যয়টির বদলে আরো বেশি অর্থবহ – রাজনৈতিক কাঠামো প্রত্যয়টি ব্যবহার করা উচিত।

রাজনৈতিক কাঠামো প্রত্যয়টি সামগ্রিকভাবে সব সামাজিক কাঠামোকে নির্দেশ করে যারা যৌথভাবে পারস্পারিকভাবে সম্পর্কিত সামাজিক সিদ্ধান্তগুলি নির্ধারণ করে। আধুনিক সময়ে যা রাজনৈতিক শাসনতন্ত্র , রাজনৈতিক দল এবং আরো অন্যান্য সংস্থাকে নির্দেশ করে। ফলে রাজনৈতিক কাঠামো, রাষ্ট্রের তুলানায় ব্যাপকার্থ ধারণ করে।

রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক বিবর্তন

প্রাথমিক স্তরের রাষ্ট্রের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায় যখনই ক্ষমতাকে টেকসইভাবে কেন্দ্রীভূত করা যায়। “কৃষি ও কলম” প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। কৃষি, উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদন ও তার সঞ্চয়কে সম্ভব করে তুলেছে। এটাই পর্যায়ক্রমে এমন এক শ্রেণীর উদ্ভব সম্ভব করে তুলেছে যারা কৃষি উদ্বৃত্তের মজুত নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষা করতো। একই সাথে এই কাজে সময় ব্যয় করায় তারা ক্রমেই তাদের নিজেদের জীবিকানির্বাহী কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এছাড়াও রয়েছে লেখনীর বিকাশের ব্যাপারটি, যা প্রয়োজনীয় তথ্যের একত্রিত উপস্থাপন সম্ভব করেছে।

অনেক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বিশ্বাস করেন যে রাষ্ট্রের মূলসূত্র আদিবাসীদের সংস্কৃতিতে প্রোথিত। সে সংস্কৃতি মানুষের বোধের সাথে সাথে সেই কাঠামোকে উন্নত করেছে যা আদি পুরুষতান্ত্রিক ক্ষুদ্রসমাজের নজির, যেখানে দুর্বলের উপর সবলের দাপটই মুখ্য ছিলো। যাহোক, নৃবিজ্ঞানীদের মতে আদিবাসী গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজে উল্ল্যেখ করা মত কোন কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ছিল না। আর সেটাই সমাজগুলোকে বহুস্তরবিশিষ্ট করে তুলেছিলো।

প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় রাষ্ট্রচিন্তা

রোমান সিনেট

পশ্চিমে রাষ্ট্রের ইতিহাস শুরু হয় গ্রিক ও রোমান সভ্যতাকালে। সেইসময়কালে রাষ্ট্রকে বিভিন্ন রূপে দেখতে পাওয়া যায়। যদিও তাদের কোনটিকেই আধুনিক রাষ্ট্রের সাথে মেলানো যায় না। তখন স্বাধীন শাসকদের এমন এক শ্রেণী ছিল যাদের ক্ষমতা মূলত রাজার ধর্মীয় কর্মকাণ্ড ও কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীতে তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল ছিলো। সেখানে রোমান সাম্রাজ্যের মত আমলাতন্ত্রনির্ভর বৃহৎ সাম্রাজ্যও ছিলো যা রাজার ধর্মীয় প্রভাব দ্বারা ছিল কম প্রভাবিত। কার্যকর সেনাবাহিনী ও আইনি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং সুদৃঢ় অবস্থানে থাকা অভিজাততন্ত্রের উপরই নির্ভরতা ছিলো বেশি।

মনে করা হয় যে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় সবচেয়ে বড় রাজনীতি সংক্রান্ত উদ্ভাবন ছিলো গ্রিক নগর-রাষ্ট্র এবং রোমান প্রজাতন্ত্র। চতুর্দশ শতকেরও আগে গ্রিক নগর-রাষ্ট্র তার মুক্ত বাসিন্দাদের জন্য নাগরিকত্ব প্রদান করে। এথেন্সে এই অধিকার স্বীকৃতি পায় গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতির প্রত্যক্ষ রূপের মাধ্যমে যা পরবর্তীতে ইতিহাস ও রাষ্ট্র চিন্তায় দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।

অন্যদিকে রোমে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্র, যা রোমান অভিজাতদের দ্বারা প্রভাবিত সদস্যসভা দ্বারা শাসিত হত। রোমান রাজনৈতিক কাঠামো, আইন ও নিয়মতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের উন্নতিতে অবদান রাখে এবং একই সাথে অধিকার-কর্তব্যের ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রের মাঝে সুস্পষ্ট সীমারেখা টেনে দেয়।

পশ্চিমে সামন্তসমাজ থেকে আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব

পশ্চিমে সুনির্দিষ্টভাবে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে রোমান সাম্রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটার মাধ্যমে। এর ফলে সাম্রাজ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভাজিত হয়ে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণবিহীন স্থানীয় জমিদারদের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, যাদের রাজনৈতিক, আইনি ও সামরিক সিদ্ধান্তগুলো ছিলো স্থানীয় উৎপাদন কাঠামোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্ধারিত। মার্ক্সবাদীদের মতে এমন পরিস্থিতিতেই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো স্থানীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

সামন্তযুগের ইউরোপে একজন স্বাধীন শাসক আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা কাঠামোর উপরে থাকলেও তার একক ইচ্ছা পুরো শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য যথেষ্ট ছিল না। বরং কেন্দ্রীয় খাজনা আদায় ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে স্বাধীন শাসক ও জমিদারদের ভেতর পারস্পারিক নির্ভরতার সম্পর্ক ছিলো। এ অবস্থা ম্যাক্স ওয়েবার বর্ণিত রাষ্ট্র এর সাথে পুরোপুরি মেলে না যেহেতু এমতাবস্থায় না আইন তৈরি আর না তো বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজার একচ্ছত্র অধিকা ছিলো। আইনের তৈরির ব্যাপারে গির্জার প্রভাব ছিলো আর বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে “নোবল্‌” পদাধিকারীদের প্রভাব ছিলো।

খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে রাজা ও অন্যান্য ক্ষমতা উৎসগুলোর ভেতর টানাপোড়েন এর জের ধরে স্ট্যান্ডেস্ট্যাট এর জন্ম হয় যেখানে সংসদ এর মত আলোচনার পরিবেশে রাজা ও ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আইনিঅর্থনৈতিক বিষয়ে দেন-দরবারের মীমাংসা হত। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই দেন-দরবারের ব্যাপারে রাজারই প্রাধান্য থাকতো।

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্মেষধারা

নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ তৈরির মাধ্যমে রাষ্ট্রের জনসম্পৃক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় ইউরোপে প্রাতিষ্ঠানীকিকরণের ক্রমোন্নতির হাত ধরে, যার সূচনা হয় পনের শতকের শেষভাগে, যা স্বৈরতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের উত্থানের সাথে সাথে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়।

ইউরোপের পরিবারতান্ত্রিক রাজ্যগুলো ( ইংল্যান্ডের, স্পেনের এবং ফ্রান্সের) রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রণীত বিভিন্ন পরিকল্পনার আত্মীকরণ করে যা ক্রামাগত আধুনিক রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলিকেই সামনে নিয়ে আসে।

ইউরোপিয়ান রাজতন্ত্রগুলো ক্রমান্নয়ে ক্ষমতার অন্যান্য উৎসগুলোর কোন কোন্টিকে দমন আবার কোন কোনটিকে সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করায় (চার্চ, সীমিত নোবলিটি) ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ একই সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতা কর্তব্যের সীমানা স্পষ্ট করে এঁকে দেয়।

প্রায় ক্ষেত্রেই সীমানা নিয়ে বিবাদ ছিলো যে সামন্ত শাসনে, তার বদলে গড়ে ওঠে এককেন্দ্রীক রাষ্ট্রের, যার নির্দিষ্ট এলাকার উপর ব্যাপক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রক্রিয়া, ব্যাপকভাবে কেন্দ্রীভূত এবং ক্রমশ আমলাতন্ত্র নির্ভরপ্রবণ বিভিন্ন প্রকার একনায়কতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের জন্ম দেয়। সতের এবং আঠারো শতকে এটি ঘটে, যখন রাষ্ট্র ব্যবস্থার সমকালীন বৈশিষ্ট্যগুলো কাঠামোবদ্ধ রূপ লাভ করে। এতে অন্তর্ভুক্ত হয় নিয়মিত সেনাবাহিনী, কেন্দ্রীয় কর ব্যবস্থা, স্থায়ী দূতাবাসগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতির উন্নয়ন ।

সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তার অভিন্নতা আধুনিক রাষ্ট্রের উথ্থানে ব্যাপকবিস্তারী ভূমিকা রেখেছে। একনায়কতান্ত্রিক সময়কাল থেকেই রাষ্ট্রের সংগঠন বহুলাংশে জাতীয়তা নির্ভর। একথা স্পষ্ট হওয়া দরকার যে জাতীয় রাষ্ট্র আর জাতি-রাষ্ট্র এক বিষয় নয়। এমন কি নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ঐক্য সবচেয়ে বেশি এমন সমাজেও রাষ্ট্র ও জাতির বৈশিষ্ট্য সমভাবে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠে না। ফলে প্রায়ক্ষেত্রেই ষেয়ার্ড সিম্বল ও জাতীয় পরিচয়ের উপর জোর দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র জাতীয়বাদের প্রচার ও প্রসারে কাজ করে।

এই সময়কালেই রাষ্ট্র ব্যাপারটি বর্তমান অর্থের কাছাকাছি অর্থে রাষ্ট্র তত্ত্বের আলোচনায় ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৫৩২ সালে প্রকাশিত দ্য প্রিন্স গ্রন্থে, আধুনিক অর্থে নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে সার্বভৌম সরকারক অর্থে রাষ্ট্রের ব্যবহারের জন্য কৃতিত্ব দেয়া হয় ম্যাকিয়াভেলিকে। যদিও ব্রিটিশ চিন্তাবিদ থমাস হব্সজন লক এবং ফরাসি চিন্তাবিদ জেন বডিনের হাত ধরেই রাষ্ট্রের বর্তমান অর্থ পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বর্তমানকালের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই ম্যাক্স ওয়েবারের পলিটিক্স এ্যাজ ভোকেশন-এ বর্ণিত সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে। ওয়েবারের মতে আধুনিক রাষ্ট্র নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের ভেতর বলপ্রয়োগের সব মাধ্যমের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।

বলপ্রয়োগের এই যে একচ্ছত্র ক্ষমতা, তার আবার বিশেষ ধরনের। কারণ একে আবার আমধারণা অনুযায়ী আইনসিদ্ধ হতে হবে যে আইন ব্যক্তি স্বার্থানু্যায়ী প্রণিত নয়।

আবার এমন রাষ্ট্রেরও অস্তিত্ব আছে যা ওয়েবারের সঙ্গার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নির্দিষ্ট এলাকায় বলপ্রয়োগের মাধ্যমের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেই বা সেই বলপ্রয়োগের আমধারণা অনু্যায়ী আইনি ভিত্তি নেই এমন রাষ্ট্রও আছে যাদেরকে সামন্তসমাজের মত অন্যান্য কাঠামো থেকে পৃথক করা যায় আমলাতন্ত্রের উপর তাদের নির্ভরতা এবং বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করার বৈশিষ্ট্যের কারণে।

মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকেরা আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করেন সামাজিক শ্রেণীগুলোর ভেতর উপস্থিত শ্রেণী সংঘাতের ধারণার উপর ভিত্তি করে।

রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজ

আধুনিক রাষ্ট্রের সাথে নাগরিক সমাজের সংযুক্ত-বিযুক্ত থাকা প্রসঙ্গে থমাস হব্স, জে. জে. রোসাও, ইমানুয়েল কান্ট এর মত ধ্রুপদী চিন্তাবিদেরা যেখানে রাষ্ট্র ও সমাজের পরিচয় নির্দিষ্ট করার কাজে মনোযোগ দিয়েছেন, সেখানে জি. ডাব্লুউ. এফ. হেগেল ও অ্যালেক্সিস ডি টোকভিল থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদেরা বরং দু’টি ভিন্ন ভিন্ন সত্ত্বা হিসেবে তাদের মধ্যকার সম্পর্কের স্বরূপ নিরূপণে মনোযোগ দিয়েছেন।

রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল

১৯ শতকের শেষভাগ থেকে পৃথিবীর আবাসযোগ্য সমগ্র ভূমি কম-বেশি নির্ধারিত সীমানা দ্বারা বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের নামে চিহ্নিত হয়ে যায়। আগে বেশ বড় বড় এলাকা হয় নির্দাবিকৃত ছিল না হয় অনাবাসকৃত ছিল অথবা যাযাবরদের এমন আবাসস্থল ছিল যা রাষ্ট্র হিসেবে সংগঠিত ছিল না। বর্তমানে ২০০ এর ও বেশি রাষ্ট্রকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গঠিত যাদের সিংহভাগই জাতিসংঘের সদস্য দেশ

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিকদের মতে এই রাষ্ট্রগুলো এমন একটি ব্যবস্থাপনার ভেতর আছে যেখানে রাষ্ট্র নিজে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অপরাপর রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করে। এদিক থেকে দেখতে গেলে আন্তঃ ও বহিঃ নিরাপত্তার ব্যাপারে ও বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র উভয় সংকটে থাকে।

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলতে এমন রাষ্ট্রসমূহের গোষ্ঠীকে বোঝায় যারা তাদের সম্পর্ক পরিচালনার জন্য বিধি, কার্যপ্রণালী ও প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। একইভাবে আন্তর্জাতিক আইন, কূটনীতি, আনুষ্ঠানিক রেজিম এবং সংগঠনগুলোর ভিত্তি তৈরি হয়েছে।

রাষ্ট্র এবং অধিজাতীয়তাবাদ

বিশ শতকের শেষভাগ থেকে পৃথিবীর অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের প্রভাব, শ্রমমূলধনের প্রবাহ এবং বহুসংখ্যক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভবের যৌথ প্রভাবে রাষ্ট্রসমূহের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে গিয়েছে। স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই সীমাবদ্ধতার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হল পশ্চিম ইউরোপ যেখানে আন্তঃরাষ্ট্রীয় ঐক্যের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যদিও ১৬ শতক থেকে এখনো রাষ্ট্রই বিশ্বের রাজনৈতিক একক। ফলে রাষ্ট্রকেই রাজনৈতিক পঠন পাঠনের মূল কেন্দ্রীয় বিষয় বলে মনে করা হয় এবং এর সংজ্ঞা নিয়েই তাত্ত্বিকদের মাঝে পাণ্ডিত্বপূর্ণ বিতর্ক সবচেয়ে বেশি হয়।

রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক আইন

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাম্প্রতিক প্রবণতা ও আইন অনুযায়ী একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নির্ভর করে ঐ রাষ্ট্রের, রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে দাবী করার ব্যাপারে কূটনৈতিক স্বীকৃতি থাকা না থাকার উপর। স্বীকৃতি ও সার্বভৌমত্বের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

রাষ্ট্র হওয়ার জন্য আইনি শর্তাবলী অবশ্য পালনীয় নয়। প্রায় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আইনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রায়ই যে দলিলের কথা উল্লেখ করা হয় তা হলো ১৯৩৩ সালের মন্টেভিডিও সমঝোতার প্রথম ধারা যাতে আছেঃ

আন্তর্জাতিক আইনের একটি অংশগ্রহণকারী পক্ষ হিসেবে রাষ্ট্রকে নিম্নোক্ত শর্তাবলী পূরণ করতে হবে-

ক. স্থায়ী জনগণ খ. নির্ধারণকৃত এলাকা গ. সরকার ঘ. অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক তৈরির সক্ষমতা

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ