অংকীয়া নাট

ভারতপিডিয়া থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন

অংকীয়া নাট হচ্ছে মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শংকরদেব এবং মাধবদেব পৌরাণিক আখ্যানর ভিত্তিতে ব্রজবুলি ভাষায় রচনা করা নাটসমূহ। মহাপুরুষ দুজনই তাদের রচনা করা নাটসমূহকে যাত্রা ঝুমুরাই বলেছিলেন। পরবর্তী কালে কোনো কোনো বৈষ্ণব ভকত একে অংকীয়া নাট বলে নামকরণ করেন। একে অংকীয়া ভাওনা বলেও ডাকা হয়। ভাওনা শব্দের প্রকৃত অর্থ ভাব দিয়ে দেখানো কার্য। অংকীয়া নাটের অভিনয়কেই দরাচলে ভাওনা বলা হয়। খ্রীষ্টিয় পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে শংকরদে‌ব দ্বারা প্র‌বর্তিত ধর্মীয় তথা জনপ্রিয় মনোরঞ্জনর মাধ্যম অংকীয়া নাট ভাওনাই হল অসমীয়া নাট ইতিহাসের প্রথম নিদর্শন। তার আগে প্রাচীন কামরূপ-এর কোনো কোনো বিদ্যোৎসাহী এবং কলাপ্রেমী রাজার রাজসভায় নৃত্য, গীতি, অভিনয়ের অনুশীলন হত বলে জানা যায় যদিও সেইসমূহের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না।[১]

উৎস এবং প্রভাব

বুৎপত্তিগত অর্থের দিক থেকে দেখলে দেখা যায় যে অংকীয়া নাটের অর্থ "একাংক নাটক"। কিন্তু মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শংকরদে‌ব এবং তাঁর প্রিয় শিষ্য মাধ‌বদে‌ব তাঁদের নাটকসমূহকে "নাট", "নাটক",বা "যাত্রা" ইত্যাদি নামেরে অভিহিত করেছিলেন। 'অংকীয়া নাট' শব্দটি তুলনামূলক ভা‌বে আধুনিক শব্দ। নাট বোঝানো শব্দ ‘অংকোর সঙ্গে ‘ঈয়া’ প্রত্যয় জুড়ে পরবর্তী কালের বৈষ্ণ‌ব সমাজ এই শব্দকে বিশেষণ রূপে ব্যবহার করতে শুরু করে[১]। এই শব্দ সর্বপ্রথমে ব্যবহৃত হয় গুরুদুজনার অন্যতম শিষ্য দৈতারি ঠাকুর এবং রামচরণ ঠাকুর-এর দ্বারা রচিত চরিতগ্রন্থে[২]। গুরুদুজনার দ্বারা রচিত নাট সমূহের লিখিত পাঠকে অংকীয়া নাট এবং সেই পাঠসমূহের নাট প্রদর্শনকে অংকীয়া ভাওনা বা ভা‌বনা বলে ডাকা হয়। ‘অংকীয়া’ শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে ভিন্ন জনকে ভিন্ন মত পোষণ করতে দেখা যায়।

সংস্কৃত নাটশাস্ত্রে অঙ্ক শব্দের অর্থ হল "চিহ্ন" , অর্থাৎ নাটকীয় কাহিনীর স্তর চিহ্নিত করা বিভাগ (an Act)। এই অঙ্ক শব্দের থেকে অংকীয়া শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে বলে মত পোষণ করে কোনো কোনো পণ্ডিত। তাঁরা বলেন যে "অংক মাত্র যার আছে, সেজন্য অংকীয়া"

নাটশাস্ত্রে দশ প্রকারের নাটক বা রূপকের উল্লেখ এবং বি‌বরণ আছে। সেগুলি হল – নাটক, প্রকরণ, সম‌বকার, ঈহমৃগ, ডিম, ‌ব্যয়োগ, অংক বা উৎসৃষ্টিকাঙ্ক, প্রহসণ, ভাণ এবং ‌বিথি[৩]। এই দশরূপক বা দশ প্রকারের নাটক(রূপক)র অন্তর্গত অঙ্ক বা উৎসৃষ্টিকাঙ্ক নামের রূপক রকমের থেকে "অংক" এবং "অংকীয়া" অভিধাদুটি আসতে পারে বলেও কোনো কোনো পণ্ডিত বদলে থাকেন। কিন্তু অংকীয়া নাটে মাত্র একটিই অঙ্ক থাকার বাইরে অঙ্ক বা উৎসৃষ্টিকাঙ্ক রূপক রকমের সঙ্গে এর অন্য কোনো অন্তরঙ্গ সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না[৪]

অংকীয়া নাটের উৎস সম্পর্কিত ড: সত্যেন্দ্রনাথ শর্মাদে‌ব তাঁর “ অংকীয়া নাটের উৎপত্তি এবং বৈশিষ্ট” নামের প্র‌বন্ধে মতপোষণ করেছেন এইভাবে- “ …মহাপুরুষ দুজনের নাটে যে কলা কৌশল এবং ভাষা প্রয়োগ হয়েছিল পরের নাট লিখতে তাদের তার থেকে ভালো দিকটি কেটে গিয়েছিল। ব্রজাবলী পরিহৃত হল, নান্দীশ্লোক, ভটিমা ইত্যাদিও বর্জিত হল। মহাপুরুষ দুজনের নাট বা সেই ছাঁচে ঢালা নাটসমূহকে পরের নাট থেকে পৃথক করে দেখানোর নিমিত্তে ‘অংকীয়া নাট’-একর সৃষ্টি।”[১]

অন্যদিকে, ড॰ বিরিঞ্চি কুমার বরুয়া, “আমার ভাওনাতে আঙ্গিক অভিনয়ই মূল, সেই দেখে ‘অঙ্গ ’ শব্দের থেকে ‘অংকো শব্দটি উদ্ভূত হওয়া সম্ভ‌ব” বলে মত পোষণ করেছেন।[৪]

মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শংকরদে‌ব দ্বারা পরিবেশিত সর্বপ্রথম নাট বা ভাওনা ছিল “চিহ্নযাত্রা”; এই চিহ্নযাত্রা পরিবেশনের জন্য গুরুজন সাত বৈকুণ্ঠের চিত্রপট অঙ্কন করেছিলেন। এই কথাকে উৎস হিসাবে নিয়ে “সম্তা‌বলী” নামের চরিত গ্রন্থে অংকীয়া শব্দের ব্য‌বহার সম্পর্কে বলা হচ্ছে এইমতো - “অংকিত করেলা দেখি অংকীয়া যে নাম”। নতুন কমলাবাড়ি সত্র-এর সত্রাধিকার নারায়ণ চন্দ্র গোস্বামী দে‌ব তার “সত্রীয়া সংস্কৃতির স্বর্ণরেখা” নামের গ্রন্থে এই মতকে সঙ্গতিপূর্ণ বলে অভিহিত করে মতামত দিয়েছেন এমনভাবে—“উক্ত (সন্তা‌বলী) গ্রন্থের মতে "অংকীয়া" শব্দের অর্থ হল নাটকে অভিনেতা দের রংবরণ দিয়ে প্রবেশ করানো বা বিভিন্ন প্রকারে চিত্রপট এঁকে (পারিষদদের চিত্রে চিত্রিত করে দেখিয়ে) চোমুখা সাজিয়ে অঙ্কন করে দর্শকদের দেখাবার কারণে ‘অংকীয়া' নাম হয়। অংকীয়া নাটের মূল উৎস হল “চিহ্নযাত্রা”। অঙ্ক শব্দটি‌ এই অর্থে অঙ্কন করা বোঝায়। … “চিহ্নযাত্রা” কালে যেসব মূখা নির্মাণ করা হয়েছিল এবং চিত্রে যেসব ব্যক্তিকে চিত্রিত করা হয়েছিল, সেগুলিই পরে অংকীয়া নাম পায় এবং উত্তর কালে রচিত বাকী “বারছো‌বা” নাটও “অংকীয়া নাট” নামে পরিচিত হয়।”[৫]

তথ্যসূত্র

  1. ১.০ ১.১ ১.২ অসমীয়া নাট সাহিত্য, সত্যেন্দ্রনাথ শর্মা
  2. Ankiyanat : A Tradition of pride.(Article)-- Dr. Dayananda Pathak
  3. The Natyashastra—(Trans. & Ed.)- Dr. Manomohan Ghosh
  4. ৪.০ ৪.১ শঙ্করী সাহিত্যর সমীক্ষা-(সম্পা:)-ভ‌বপ্রসাদ চলিহা
  5. সত্রীয়া সংস্কৃতির স্বর্ণরেখা—নারায়ণ চন্দ্র গোস্বামী